jewelheron2@gmail.com

Wednesday, December 5, 2012

আশ্চর্য ছবি~সুকুমার রায়

7:44 AM

Share it Please
জাপান দেশে সেকালের এক চাষা ছিল,তার নাম কিকিতসুম।ভারি গরিব চাষা,আর যেমন গরিব তেমনি মুর্খ।দুনি্যার সে কোনই খবরই জানত না; জানত কেবল চাষাবাসের কথা,আর গ্রামের যে বুড়ো 'বজ্ঞে' {পুরহিত},তার ভাল ভাল উপদেশের কথা। চাষার যে স্ত্রী,তার নাম লিলিতসী। লিলিতসী চমৎকার ঘর রান্না করে।বাড়ির ভিতর সব তক্তাকে ঝরঝর করে গুছিয়ে রাখে,আর রান্না করে এমন সুন্দর যে চাষার মুখে প্রশংসা আর ধরে না।কিকিতসুম কেবলই বলে,"এত আমার বয়স হল,এত আমি দেখলাম শুনলাম,
কিন্তু রুপে গুনে এর মত আর একটি কোথাও দেখতে পাইনি।"লিলিতসি সে কথা যত শুনে ততই খুশী হয়।
একদিন হয়ছে কি,কোথাকার এক শহুরে বড়মানুষ এসেছেন সেই গ্রাম দেখতে;তার সংগে তার ছোট্ট মেয়েটি,আর মেয়েটির ছিল একটি ছো্ট্ট আয়না।
রাস্তায় চলতে চলতে সেই আয়নাটা সেই মেয়ের হাত থেকে কখন পরে গেছে,কেউ তা দেখতে পায়নি।
কিকিতসুম যখন চাষ করে বাড়ি ফিরছে তখন সে দেখতে পেল,রাস্তার ধারে কি একটা চক্‌চক্ করছে।সে তুলে দেখল,একটা অদ্ভুত চ্যাপ্টা চৌকোনা জিনিস!সে কিনা কখনো আয়না দেখেনি,তাই সে ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগল,এটা আবার কি রে!নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে হঠাৎ সেই আরসির ভিতরে নিজের ছায়া্র দিকে তার নজর পড়ল।সে দেখল কে একজন অচেনা লোক তার দিকে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে আছে।দেখে সে এমন চমকিয়ে উঠল যে আর একটু হলেই আয়নাটা তার হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল।তারপর অনেক ভেবে চিন্তে সে ঠিক করল,এটা নিশ্চয় আমার বাবার ছবি-দেবতারা আমার উপড় খুশি হয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন।তার বাবা মারা গিয়েছেন সে অনেকদিনকার কথা,কিন্তু তবু তার মনে হল,হ্যাঁ এইরকমই ত তার চেহারা ছিল।তারপর-কি আশ্চর্য!সে দেখল তার নিজের গলায় যেমন একটা রুপার মাদুলি,ছবির গলায় ও ঠিক তেমনি!এ মাদুলি ত তার বাবারই ছিল,তিনি ত সর্বদাই এটা গলায় দিতেন,-তবে ত এটা তার বাবারই ছবি।
তখন কিকিতসুম করল কি,আয়নাটাকে যত্ন করে কাগজ দিয়ে মুড়ে বাড়ি এল।বাড়ি এসে তার ভাবনা হল,ছবিটাকে রাখে কোথায়?তার স্ত্রীর কাছে যদি রেখে দেয়,তবে সে হয়ত পাড়ার মেয়েদের কাছে গল্প করবে,আর গ্রামসুদ্ধ সবাই এসে ছবি দেখবার জন্য ঝুঁকে পড়বে। গ্রামের মূর্খগুলো ত আর সেই ছবির মর্যাদা বুঝবে না,তারা আসবে কেবল 'তামাসা' দেখবার জন্য! তা হবে না-তার বাবার ছবি নিয়ে ছেলেবুড়ো সবাই এসে নোংরা হাতেনাড়বে-চাড়বে,তা কিছুতেই হতে পারবে না।এ ছবি দেখান হবে না,লিলিতসিকেও তার কথা বলা হবে না।
কিকিতসুম বাড়িতে এসে একটা বহু্কালের পুরানো ফুলদানির মধ্যে আরসিটাকে লুকিয়ে রাখল।কিন্তু তার মনটা আর কিছুইতে শান্ত হতে চায় না।খানিকক্ষন পরে পরেই সে একবার করে দেখে যায় ছবিটা আছে কিনা।তার পরের দিন সে মাঠে কাজ করছে,এমন সময় হঠাৎ তার মনে হল,"ছবিটা আছে ত?অমনি সে কাজকর্ম ফেলে দৌড়ে দেখতে এল।দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে বাইরে যাবে,এমন সময় লিলিতসি সেই ঘরে এসে পড়েছে। লিলিতসি বলল,"এ কী!তুমি দুপুরবেলায় ফিরে এলে যে?অসুক করেনি ত?কিকিসুম থতমত খেয়ে বলল,"না না,হঠাৎ তোমায় দেখতে ইচ্ছা করল,তাই বাড়ি এলাম।"শুনে লিলিতসি ভারি খুশি হয়ে গেল। তারপর আর একদিন এইরকম লুকিয়ে লুকিয়ে ছবি দেখতে এসে কিকিতসুম আবার তার স্ত্রীর কাছে ধরা পড়ল। সেদিনও সে বলল,"তোমার ঐ সুন্দর মুখখানা বার বার মনে হচ্ছিল,তাই একবার ছুটে এলাম।" সেদিন কিন্তু লিলিতসির মনে একটু খটকা লাগল। সে ভাবল,'কই এত দিন ত কাজ করতে করতে একবারও আমায় দেখতে আসেনি,আজকাল এরকম হচ্ছে কেন?' তারপর আর একদিন কিকিতসুম এসেছে ছবি দেখতে। সে দিন লিলিতসি টের পেয়েও দেখা দিল না-চুপি চুপি বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগল-কিকিতসুম সেই ফুলদানির ভিতর থেকে কি একটা জিনিস বার করে দেখল,তারপর খুব খুশি হয়ে যত্ন করে আবার রেখে দিল।কিকিতসুম চলে যেতেই লিলিতসি দৌড়ে এসে ফুলদানির ভিতর থেকে কাগজে মোড়া আরসিটাকে টেনে বার করল।তারপর তার মধ্যে তাকিয়ে দেখে অতি সুন্দর এক মেয়ের ছবি!তখন যে তার রাগটা হল-সে রাগে গজগজ করে বলতে লাগল,"এই জন্য রুজ বাড়িতে আসা হয়-আবার আমায় বলেন,'তোমার মুখখানা দেখতে এলাম','তোমার মত সুন্দর আর হুই না।'মগো!কি বিশ্রী মেয়েটা!হোঁৎকা মুখ,থ্যাব্ড়া নাক,ট্যারচা চোখ-আবার আমার মত করে চুল বাঁধা হয়েছে!দেখ না কি রকম হিংসুটে চেহারা!এই ছবি আবার আদর করে তুলে রেখেছেন-আর রোজ রোজ আহ্লাদ করে দেখতে আসেন।"লিলিতসির চোখ ফেটে জল আসল,সে মাটিতে উপুড় হয়ে কাদঁতে লাগল।তারপর চোখ মুছে আর একবার আরসির দিখে তাকিয়ে বলল,"মেয়েটা্র কি ছিঁচকাঁদুনে চেহারা-এমন চেহারাও কেউ পছন্দ করে!"সে তখন আয়নাটাকে নিজের কাছে লুকিয়ে রাখল।
সন্ধ্যার সময় কিকিতসুম বাড়ি এসে দেখল,লিলিতসি মুখ ভার করে মেঝের উপর বসে রয়েছে। সে ব্যাস্ত হয়ে বলল,"কি হয়েছে?"লিলিতসি বলল,"থাক থাক আদর দেখাতে হবে না-নাও তোমা্র সাধের ছবিখানা নাও।ওকে নিয়েই আদর ক'র,যত্ন ক'র,মাথায় ক'রে তুলে রাখো।"তখন কিকিতসুম গম্ভীর হয়ে বলল,'তুমি যে আমার ছবিকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করছ-জান ওটা আমার বাবার ছবি?"লিলিতসি আরো রেগে বলল,"হ্যাঁ,তোমার বাবার ছবি!আমি কচি খুকি কিনা,একটা বলে দিলেই হল!তোমার বাবার কি অমনি আহ্লাদী মেয়ের মত চেহারা ছিল?"কথটা শেষ না হতেই কিকিতসুম বলল,"তুমি না দেখেই রাগ করছ কেন?একবার ভাল ক'রে দেখই না।"এই বলে কিকিতসুম নিজে আবার দেখল। আরসির মধ্যে সেই মুখ।তখন দজনের মধ্যে ভয়ানক ঝগড়া বেধে গেল।কিকিতসুম বলে ওটা তার বাবার ছবি,লিলিতসি বলে ওটা একটা হিংসুটে মেয়ের ছবি।এই রকম তর্ক চলছে,এমন সময় গ্রামের যে বড় 'বজ্ঞে',সে তাদের গলার আওয়াজ শুনে দেখতে এল ব্যাপারখানা কি!পুরুতঠাকুরকে দেখে দুজনেই নমস্কার করে তার কাছে নালিশ লাগিয়ে দিল। কিকিতসুম বলল,"দেখুন আমার বাবার ছবি,সেদিন আমি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেলাম,আর ও কিনা বলে যে ওটা কোন এক মেয়ের ছবি।"লিলিতসি বলল,"দেখলেন কি অন্যায়! এনেছেন একটা গোমড়ামুখী মেয়ের ছবি,আর আমায় বোঝাচ্ছেন,ঐ নাকি তাঁর বাবা!"
তখন 'বজ্ঞে' ঠাকুর বললেন,"দাও ত দেখি ছবিখানা।"তিনি আরসি নিয়ে মিনিট পাঁচেক খুব গম্বীরভাবে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আয়নাটাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললেন,"তোমরা ভুল বুঝেছ।এ হচ্ছে অতি প্রাচীন এক মহাপুরুষের ছবি।আমি দেখতে পাচ্ছি,ইনি একজন যে সে লোক নন।দেখছ না মুখে কি গম্ভীর তেজ,কি রকম বুদ্ধী আর পান্ডিত্য আর কি সুন্দর প্রশান্ত অমায়িক ভাব।এ ছবিটা ত এমন করে রাখলে চলবে না; বড় মন্দির গড়ে,তার মধ্যে পাথরের বেদী বানিয়ে,তার মধ্যে ছবিখানাকে রাখতে হবে-আর ফুলচন্দন ধূপধূনা দিয়ে তার সম্মান করতে হবে।"
এই ব'লে 'বজ্ঞে' ঠাকুর আরসি নিয়ে চলে গেলেন।আর কিকিতসুম আর লিলিতসি ঝগড়া-টগড়া ভুলে খুশী হয়ে খেতে বসল।

0 comments:

Post a Comment

Twitter Update

Recent Visitor