jewelheron2@gmail.com

Tuesday, December 18, 2012

আমাদের মৌলভীবাজার,এ যেন এক অপার ঐশ্বর্য আর চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য

4:00 AM

Share it Please

দেশের উত্তর-পূবার্ঞ্চলে ২৭৯৯ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে অবস্থিত অপরূপ সৌন্দর্য্যমন্ডিত একটি জেলা মৌলভীবাজার। এর পূর্ব ও দক্ষিণে ভারত, উত্তরে সিলেট, পশ্চিমে হবিগঞ্জ। দেশের ৬১.৫২% চা বাগান অর্থাৎ বাংলাদেশের মোট ১৬৩টি চা-বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজার জেলায় ৯২টি চা বাগান রয়েছে। যার জন্য  মৌলভীবাজার জেলা বাংলাদেশের চা রাজধানী হিসেবে বেশ সুপরিচিত। রামায়ন ও মহাভারত এর মত উল্লেখযোগ্য মহাকাব্যে এ অঞ্চলের উল্লেথ রয়েছে। বৃহৎ হাওর, বনাঞ্চল, প্রবাসীদের জীবনাচার, চা-শ্রমিক ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির সামাজিক জীবন, মনিপুরী সংস্কৃতি ইত্যাদি এ জেলাকে আকর্ষণীয় করার ক্ষেত্রে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।
বলা হয়ে থাকে যে, সৈয়দ শাহ্‌ মোস্তফা (র:) এর ভাতুষ্পুত্র হযরত ইয়াছিন (র:)এর উত্তরপুরুষ মৌলভী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ মনু নদীর তীরে ১৮১০ সালে যে বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা ১৮৮২ সালের ১ এপ্রিল ২৬টি পরগনা নিয়ে
দক্ষিণ শ্রীহট্ট মহকুমা বা সাউথ সিলেট হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধে ৪ নং সেক্টরের অধীনে হয়ে সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অবঃ) সি আর দত্ত- বীর উত্তম এর তত্ত্বাবধানে এই জেলা ৮ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয়। ১৯৮৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শ্রীহট্ট মহকুমা বা সাউথ সিলেট মৌলভীবাজার জেলায় উন্নীত হয়।
পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো অনেক কিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এই জেলায়। পাহাড়, টিলা, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, হাওড়/বাওড়/বিল, ঝর্ণা, নদ-নদী পরিবেষ্টিত এবং জীব বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এ জেলা ইকো ট্যুরিজমের (Eco-Tourism)জন্য খুবই উপযোগী। তাছড়া এখানকার যোগাযোগ ব্যাবস্থা তুলনামূলক উন্নত ও আধুনিক। এ কারণে এখানে প্রতি বছর বহু সংখ্যক দেশী-বিদেশী পর্যটক ভ্রমণ করেন। জেলার বড়লেখা উপজেলায় রয়েছে দেশের সর্ব বৃহৎ জলপ্রপাত মাধবকৃন্ড যেখানে প্রায় ৮৩ মিটার উচু পাহাড়ের উপর থেকে জলরাশি অবিরাম ধারার নয়নাভিরাম দৃশ্য সকলের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। কমলগঞ্জ উপজেলায় আছে মাধবপুর হ্রদ,ধলই সীমান্তে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহি হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ। কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, সুন্দরবনের পরেই যার স্থান। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর জাতীয় উদ্যানে এখনও টিকে রয়েছে বেশ কিছু বিরল প্রজাতীর পশুপাখি, যাদের মধ্যে উল্লুক (গিবন) অন্যতম। এছাড়াও রয়েছে হনুমান (ক্যাপড লেংগুর) লজ্জাবতী বানর (স্নো লোরিন), কুল বানর (পিগ টেইলড ম্যাকাও), কাঠবিড়ালী, হরিণ ইত্যাদি। রয়েছে হামহাম জলপ্রপাত ও মণিপুরি তাঁত পল্লী। শ্রীমঙ্গলে চা-বাগান ছাড়াও রয়েছে বাংলাদেশ চা-গবেষণা ইনস্টিটিউট (বি,টি,আর,আই)। রয়েছে কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত বিচিত্র জলজ উদ্ভিদ ও অতিথি পাখির বৈচিত্র্যে ভরা এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম হাকালুকি হাওর। মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা জুড়ে আছে হাইল-হাওর। এর পূর্ব দিকে প্রায় ১০০ হেক্টর আয়তনের একটি জলাভূমির নাম বাইক্কা বিল যা দেশে-বিদেশে পরিচিত মৎস্য ও পাখির অভায়াশ্রম। মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত কাওয়াদীঘি হাওর। এর পাশেই স্থাপিত কাশিমপুর পাম্প হাউস। রাজনগরে কমলা রানীর দীঘি। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বর্ষিজোরা ইকোপার্ক, হজরত শাহ মোস্তফার (র.) মাজার, ঐতিহাসিক খোজার মসজিদ, অজ্ঞান ঠাকুরের দেউল, ও মনু ব্যারেজ যেখানে বন্যার প্রকোপ থেকে কুলাউড়া, কমলগঞ্জ, রাজনগর ও মৌলভীবাজার উপজেলার ৫৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষায় এটি তৈরী করা হয়। এ ব্যারেজে একটি খননকৃত লেক আছে যেখানে প্যাডেল বোটে পরিভ্রমণের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া বড়লেখা, জুড়ী, কুলাউড়া, কমলগঞ্জ, রাজনগর ও শ্রীমঙ্গল উপজেলায় রয়েছে আদিবাসী খাসিদের (খাসিয়া) পানপুঞ্জি। রয়েছে খাসিয়া, সাঁওতাল, গারো, ত্রিপুরাসহ (টিপরা) বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বাস ও তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। কমলা বাগান, আনারস, কাঁঠাল, লেবুসহ নানা মৌসুমি ফলের বাগান, যা বছরের ১২ মাসই পর্যটকদের আকর্ষণ করে থাকে।
মৌলভীবাজার জেলায় অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব আছেন যাদের কল্যানে মৌলভীবাজার আরও বিকাশ লাভ করে। এঁদের মধ্যে আছেন- বাংলা কথা সাহিত্যের প্রাণ পুরুষ সৈয়দ মুজতবা আলী, বহু গ্রন্থপ্রণেতা দ্বিজেন্দ্র শর্মা {বড়লেখা উপজেলার শিবলিয়া গ্রাম}, কোলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি গীতেশ রঞ্জন ভট্টাচার্য্য {রাজনগর উপজেলার হাঁসখলা গ্রামে৷ }, উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ কর্মকার শ্রী জনার্দন {রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রাম}, সিলেট বিভাগের প্রথম ডিএসপি ও প্রথম বৈজ্ঞানিক ড. সুরেন্দ্র নাথ ধর {মৌলভীবাজার জেলার বাউরভাগ গ্রাম}, আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ও সিলেট এমসি কলেজের প্রথম মুসলিম ছাত্র আব্দুল খালিক চৌধুরী {কুলাউড়া উপজেলার বিজলী গ্রাম}, বাংলাদেশী মার্কিন পদার্থ বিজ্ঞানী ও নাসা কর্মরত বাংলাদেশের প্রথম ব্যাক্তি ও ইলেক্টো-অপটিক্স গবেষণার অন্যতম পথিকৃত ডঃ মোহাম্মদ আতাউল করিম{বড়লেখা}, বিচারপতি সিকন্দর আলী {বড়লেখা উপজেলার ইনাইনগর গ্রাম}, ক্রীড়াবিদ হিসেবে হাসিবুল হোসেন শান্ত {বড়লেখা}, বৃটিশ আমলে আসাম বেঙ্গলের ডি এস পি গগন চন্দ্র সনেগুপ্ত{মৌলভীবাজার জেলার বারহাল গ্রাম}, মধ্যযুগের শ্রেষ্ট কবি  সৈয়দ শাহনূর {রাজনগর উপজেলার ঘড়গাঁও গ্রাম}, সিলেট বিভাগের প্রথম ইতিহাস লেখক কাজী মুহম্মদ আহমদ {মৌলভীবাজার জেলার ধউপাশা গ্রাম}, সিলেট বিভাগের লোক সাহিত্যের পথিকৃত  আশরাফ হোসেন-সাহিত্য রত্ন {কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর গ্রাম}, সিলেট বিভাগের প্রথম সাংবাদিক  গৌরী শংকর ভট্টাচার্য্য তর্কবাগীশ {রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রামে}। এছাড়া আরও আছেন মাওলানা আব্দুর রহমান সিংকাপনী, আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী, দেওয়ান আব্দুল হামিদ চৌধুরী, কমরেড তারা মিয়া, হজরত শাহ মোস্তফা(রঃ) যিনি ছিলেন হজরত শাহ জালাল(রঃ) এর অন্যতম সহযোগী, সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রাহমান প্রমুখ।

খনিজ সম্পদে ও সমৃদ্ধ মৌলভীবাজার জেলা। দেশের একমাত্র তেজস্ক্রিয় পদার্থ মূল্যবান খনিজ সম্পদ ইউরেনিয়াম সন্ধান মেলে মৌলভীবাজার জেলায় বড়লেখা (বর্তমান জুড়ি) উপজেলার ফুলতলা ও সাগরনাল ইউনিয়নের মধ্যবর্তী হারাগাছা (ষাঁড়েরগজ) পাহাড়ে। কয়লা ও গ্যাসের পরিবর্তে এ অঞ্চলে প্রাপ্ত ইউরেনিয়াম আকরিক ব্যবহার করে গড়ে উঠতে পারে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এছাড়া কালাপুর, শ্রীমঙ্গল, ভাটেরা, কুলাউড়ায় ৫ টি গ্যাস কুপ ও ২ টি গ্যাস ফিল্ড রয়েছে। ২১ মার্চ, ২০০৫ইং হতে প্রতিদিন ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়। মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলায় বরমচাল পাহাড়ে অবস্থিত ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাস ক্ষেত্রে ৪নং কূƒপ থেকে ২ কোটি ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রীডে যোগ করা হচ্ছে। এ কুপটিতে ৪টি পৃথক স্তরে গ্যাস পাওয়ার ঘোষণা দেয় বাপেক্স। সাম্প্রতি কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার  ইউনিয়নের  নাছনী  গ্রামের হাওর এলাকায় বালু ও মাটি খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া গেছে বিপুল পরিমাণ কয়লা।

মৌলভীবাজার জেলায় মোট ১০৩২ টি মাঝারী শিল্প রয়েছে । এর মধ্যে বড়লেখা উপজেলায় অবস্থিত আগর আতর শিল্প এবং প্রায় সবগুলো উপজেলায় অবস্থিত প্রাকৃতিক রাবার শিল্প উল্লেখযোগ্য । এ জেলায় মোট ৪৫৭৫ টি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প রয়েছে । এর মধ্যে শীতলপাটি, বেত, কাঠ ও বাঁশ শিল্প বেশ উল্লেখযোগ্য। 


এক নজরে দেখে নিন আরও কিছু তথ্যঃ
উপজেলা-০৭টি (মৌলভীবাজার সদর,রাজনগর,কুলাউড়া,বড়লেখা,কমলগঞ্জ,শ্রীমঙ্গল ও জুড়ী)
পৌরসভা-০৫ টি (মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, বড়লেখা, কমলগঞ্জ)
ইউনিয়ন-৬৭ টি
গ্রাম-২১৩৪ টি
মোট জনসংখ্যা-১৬,১২,৩৭৪ জন (২০০১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী)
ক) পুরুষ -৮,২০,৬৮৬ জন
খ) মহিলা-৭,৯১,৬৮৮ জন
প্রবাহিত নদীর সংখ্যা-৬টি; যথা- (১) মনু নদী, মৌলভীবাজার (২) ধলাই নদী, কমলগঞ্জ (৩) সোনাই নদী (৪) ফানাই নদী (৫) কন্টিনালা নদী (৬) জুড়ী নদী (৭) বিলাম নদী।

এক নজরে দর্শনীয়/উল্লেখযোগ্য স্থানঃ
ক) পাখি বাড়ি (রাজনগর)
খ) পৃথিমপাশা নবাব বাড়ি,
গ) কমলার বাগান (জুড়ী)
ঘ) হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা(রঃ) এর মাজার শরীফ; মনু ব্যারেজ, চাঁদনীঘাট ইউ,পি, গয়ঘর ঐতিহাসিক খোজার মসজিদ, বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক, কাগাবালা পাখি বাড়ি (মৌলভীবাজার সদর)
ঙ) মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, হাকালুকি হাওর, আগর-আতর শিল্প (বড়লেখা)
চ) বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট, শ্রীমঙ্গল টি রিসোর্ট, হাইল হাওর (শ্রীমঙ্গল)
ছ) মাধবপুর চা বাগান লেইক, লাওয়াছড়া রিজার্ভ ফরেষ্ট,
জ) বীর শ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের সমাধি (কমলগঞ্জ)

নগরীর নাগরিক জটিলতা ও যান্ত্রিকতায় হাঁপিয়ে উঠেছেন, মন চাইছে একটু প্রশান্তি, চোখ খুঁজছে সবুজ দিগন্ত আর কান যান্ত্রিকার ঝাঝালো শব্দ থেকে পরিত্রাণ পেতে শুনতে চাইছে পাখ-পাখালীর সুমিষ্ট কলতান। এসবের সবই পাওয়া যাবে আমাদের মৌলভীবাজারে। অথিতি পাখিরা আসে অথিতি হয়ে, এখানকার প্রকৃতি উদার হয়ে আপ্যায়ন করায় সে সব অথিতিদের। সাম্প্রতি জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এর সফর আমাদেরকে আনন্দে সিক্ত করে।

0 comments:

Post a Comment

Twitter Update

Recent Visitor